Biography

সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী

photo 2021 08 08 13 30 30

সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী

সুলতান মালিক শাহ

জন্মঃ ১০৫৫ – মৃত্যঃ ১০৯২

          লেখকঃ আসলিহান হাতুন 

মালিক-শাহ জন্মগ্রহণ করেছেন ১০৫৫ সালের ১৬ ই আগষ্ট। জন্মকালে তার নাম ছিলো মালিক বেগ। শৈশবের বেশিরভাগ সময় তিনি ইসফাহানেই অতিবাহিত করেন। দ্বাদশ শতাব্দীর পার্সিয়ান ঐতিহাসিক মুহাম্মদ বিন আলী রাওয়ান্দি মালিক শাহ এর বৈশিষ্ট্যে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, মালিক-শাহের ত্বক ফর্সা ছিল, লম্বা এবং কিছুটা ভারী দৈহিক ধরনের ছিল। ১০৬৪ সালে মালিক-শাহ ততক্ষণে মাত্র নয় বছর বয়সী, নিজাম আল-মুলকের সাথে পার্সিয়ান সাম্রাজ্যের উজির হিসেবে নিযুক্ত হন। এরপর তিনি ককেশাসে আল্প আরস্লানের প্রচারে অংশ নিয়েছিলেন। পরে মালিক-শাহ করখানিদ খান ইব্রাহিম তমঘাচ-খানের কন্যা তেরকিন খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ১০৬৬ সালে, অলপ আরসলান মারভের কাছে একটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেন, যেখানে তিনি মালিক-শাহকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসাবে নিযুক্ত করেছিলেন এবং মালিক শাহকে ইসফাহানের শাসন ভার অর্পণ করেন।
১০৭২ সালে তিনি তার পিতা সেলজুক সুলতান আল্প আরসালানের উত্তরাধীকারী হন। এবং মালিক শাহ উপাধি গ্রহণ করেন। আল্প আরসালানের মৃত্যুর পর তার পুত্র মালিক শাহ জালালুদ্দৌলা ( সম্রাজ্যের গৌরব ) উপাধি গ্রহণ করে সুলতান পদে অধিষ্ঠিত হন। ১০৯২ সালে তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় আসীন ছিলেন।
তিনি সেলজুক বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ নরপতি ছিলেন। সেলজুকদের ইতিহাসে তার রাজত্বকাল একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় যোজন করে। মালিক শাহের রাজত্বের প্রথমদিকে কয়েকটি বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তার স্বীয় ভ্রাতও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তিনি তরবারি এবং বুদ্ধিবলে এ সমস্ত বিদ্রোহ দমন করে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
মালিক শাহ রাজধানী ইস্পাহান হতে বাগদাদ আনয়ন করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে জ্ঞানী মহান ও ন্যায়পরায়ণ শাসক হিসেবে মালিক শাহের খ্যাতি চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। চীনের সীমান্ত হতে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এবং উত্তরে জর্জিয়া হতে দক্ষিণে ইয়েমেন পর্যন্ত বিস্তৃত সুলতানের বিশাল সম্রাজ্যের সর্বত্র শান্তি বিরাজ করত। তিনি রাজ্য জয় অপেক্ষ শাসন সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তার শাসনকালে সেলযুক সাম্রাজ্য অর্ধ-পৃথিবী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
মালিক শাহ দ্বাদশবার বিশাল সম্রাজ্যের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত পরিভ্রমণ করে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক প্রদেশের অবস্থা ও অভাব, অভিযোগ পরীক্ষা করেন। হারুন অর রশীদ ও মামুনের মত তিনি বণিক, হজযাত্রী এবং পথিকদের নিরাপত্তা বিধানের জন্য বাণিজ্য ও তীর্থযাত্রার পথে বিশ্রামাগার এবং প্রহরা গৃহ স্থাপন করেন। মৃগয়ার প্রতি সুলতানের পরম আসক্তি ছিল কিন্তু প্রমোদ ভ্রমণে যাওয়ার সময়ও তিনি দরিদ্র ও কৃষকদের কথা ভুলে যেতেন না। তার সময় কৃষি শিল্প ও বাণিজ্য বিশেষভাবে প্রসার লাভ করেছিল। তিনি অসংখ্য রাস্তাঘাট ও মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সম্রাজ্যের উন্নতির জন্য বহু খাল খনন করেন। তিনি অনেক স্কুল কলেজ এবং হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। বাগদাদে আব্বাসী খলিফার প্রতিপত্তি যখন স্তিমিত হয়ে যায় তখন তিনিই ইসলামী জাহানের গৌরব ঝান্ডা বহন করেন। আড়ম্বর ঐশ্বর্য ও জনসাধারণের সমৃদ্ধিতে মালিক শাহের রাজত্বকাল রোমান অথবা আরব শাসনের শ্রেষ্ঠ যুগের সমকক্ষ ছিল।
মালিক শাহের রাজত্বকালে সেলজুক শাসনাধীন অঞ্চল জুড়ে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। মালিক শাহ নিশাপুরে একটি মানমন্দির স্থাপন করেন। কিন্তু তার সর্বাপেক্ষা গৌরবময় কীর্তি হচ্ছে জালালী ক্যালেন্ডার প্রস্তুত। ১০৭৪ খ্রীস্টাব্দে মন্ত্রী নিযামুল মুলকের পরামর্শক্রমে মালিক শাহ নিশাপুরে ৭০ জন জ্যোতির্বিদের একটি সম্মেলন আহ্বান করে তাদের উপর পারসিক পঞ্জিকা সংস্কারের কার্যভার অর্পন করেন। উক্ত সম্মলনে সভাপতিত্ব করেন রাজজ্যোতির্বিদ খ্যাতনামা ওমর খৈয়াম। তারা প্রচলিত গণান পদ্ধতির ভুল সংশোধন ও পরিমার্জন করে চান্দ্র মাসের পরিবর্তে সৌর মাস গণনার প্রথা প্রবর্তন করেন। সুলতান মালিক শাহ জালালুদ্দৌলাহর নামানুসারে এ নতুন সনের নামকরণ হয় “জালালী সন” ( jalali calendar ) ঐতিহাসিক গীবন বলেন, “এ গণনা নির্ভুলতায় জুলীয় গণনাকে অতিক্রম করে গ্রেগরীয় গণনার কাছাকাছি পৌছেছিল ।” আধুনিক পন্ডিতগণের দৃষ্টিতে বর্তমানকালের প্রচলিত পদ্ধতি অপেক্ষা এ গণনা পদ্ধতি বেশী সুক্ষ্ম ও নির্ভুল ছিল।
বাবা আল্প আরসালানের মৃত্যুর পরে মালিক-শাহ সাম্রাজ্যের নতুন সুলতান হিসাবে সিংহাসনে আরোহন করেন। কিন্তু মালিক-শাহ শান্তিপূর্ণভাবে সিংহাসনে প্রবেশ করতে পারেননি। সে সময় তার চাচা কাভর্টের সাথে তার বিরোধ দেখা দেয়। তার চাচাও চাইছিলেন সিংহাসনের অধিকার নিজের কাছে রাখতে। আর এর জের ধরেই, পিতার হত্যাকান্ডের পর সুলতান মালিক শাহকে তার চাচা কাভুর্টের সাথে মোকাবেলা করতে হয়। ১০৭৪ সালের জানুয়ারিতে হামাদানের নিকটে তাদের বাহিনী মুখোমুখি হয়। যুদ্ধের আগে, তাঁর চাচা কভুর্ট নিজের জন্য সিংহাসন দাবি করেছিলেন এবং মালিক-শাহকে একটি বার্তা প্রেরণ করেছিলেন যাতে বলা হয়েছিল: “আমি বড় ভাই আরসলানের উত্তরাধিকার এবং আপনি একটি যুবক পুত্র; আমার ভাইয়ের সিংহাসনে আমার অধিকার আছে, “
তারপরে মালিক-শাহ নীচের বার্তাটি পাঠিয়ে জবাব দিলেন: “ছেলে থাকলে ভাই উত্তরাধিকার হয় না।”
এই বার্তাটি কাভুর্টকে বাক্রুদ্ধ করেছিল, যিনি এরপরে ইসফাহান অধিকার করেছিলেন। ১০৭৪ সালের জানুয়ারিতে হামদানের কাছে একটি যুদ্ধ হয়েছিল, যা তিন দিন স্থায়ী হয়েছিল। কাভার্টের সাথে তার সাতজন পুত্র ছিল এবং কাভুর্টের বাহিনী আল্প আরসালানের সেনাবাহিনীর তুর্কমেনদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। অন্যদিকে মালিক শাহের বাহিনী গোলাম (“সামরিক দাস”) এবং কুর্দি ও আরব সৈন্য দ্বারা গঠিত হয়েছিল। তুর্কমেনদের দলত্যাগের কারণে কাভুর্ট যুদ্ধে পরাজিত হন।
যুদ্ধের সময়, মালিক-শাহের সেনাবাহিনীর তুর্কিরাও তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল, তবুও তিনি কাভুর্টকে পরাজিত করেন এবং ইসফাহান দখল করতে সক্ষম হন। কাভুর্ট তখন করুণার জন্য প্রার্থনা করলেন এবং এর বিনিময়ে ওমানে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। ফলে মালিক শাহ চাচার প্রতি দয়া দেখান এবং তাকে ক্ষমা করে দেন। তবে সেসময় নিজাম আল-মুলক এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন৷ তিনি দাবি করেন যে, তাকে ছেড়ে দেওয়া দুর্বলতার ইঙ্গিত।
কিছুক্ষণ পরে কাভুর্টকে তীরের সাহায্যে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল, তার দুই পুত্রকে অন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক বলেন তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়। ধারণা করা হয় যে, মালিক শাহের উজির নিজামুল মুলকের আদেশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
মালিক শাহ সেলজুক সাম্রাজ্যের প্রধান হলেও তার উজির নিজামুল মুলকই কার্যত সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। নিযামের অধীনে সেলজুক সেনাবাহিনী গজনভিদের খোরাসানে অবরুদ্ধ করে রাখে, ফাতেমীদেরকে সিরিয়া থেকে বিতাড়িত করে, সেলজুক রাজত্বের দাবিদারদের পরাজিত করে, জর্জিয়াকে করদ রাজ্যে পরিণত করে, আঞ্চলিক গভর্নরদেরকে আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করে এবং আব্বাসীয় খলিফাকে হীনবল করে ফেলে। আনাতোলিয়ায় একটি তুর্কি অভিযানের মধ্যে দিয়ে ১০৭১ সালে আল্প আরসালান মানযিকার্টের যুদ্ধে জয়ী হন। এই অভিযানটি আতসিজ ইবনে উভাকের মত স্বাধীন তুর্কমেন সেনাবাহিনী পরিচালনা করে কোনো সেলজুক সেনাবাহিনী নয়। এই কারণে রোম সালতানাত সেলজুক পরিবারের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে।
১০৯২ সালে বাগদাদ যাওয়ার সময় সিহনার কাছে নিজামুল মুলক আততায়ীর হাতে নিহত হন। হত্যাকারী সুফির ছদ্মবেশে ছিল। নিযামের দেহরক্ষীরা তাকে তৎক্ষণাৎ হত্যা করে তাই তার সম্পর্কে তথ্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়নি। একটি মত হল হল সে ইসমাঈলীদের কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিল। এরা প্রায়ই সেলজুক কর্মকর্তা ও শাসকদের উপর এগার শতক থেকে আক্রমণ চালিয়ে আসছিল।
এরপর মেলিকশাহ নিজেও অসুস্থ বোধ করেন এবং কয়েক মাস পর মালিক-শাহ ১৯৯২ সালের ১০ নভেম্বর শিকারের সময় প্রায় ২০ বছর সগৌরবে রাজত্ব করার পর মাত্র ঊনচল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন । তেরকেন খাতুনের নির্দেশে মালিক-শাহের লাশ ইসফাহানে ফিরিয়ে নেওয়া হয়, সেখানে তাকে মাদ্রাসায় দাফন করা হয়।
তার মৃত্যুর পর সেলজুক রাজবংশ বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়। উত্তরাধীকারের প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিভিন্ন আঞ্চলিক শাসকরা সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলে এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। প্রথম ক্রুসেডের ফলে সেলজুক সাম্রাজ্যের পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে। এই ক্রুসেডের ফলে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের বিরাট অংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে পড়ে। প্রথম ক্রুসেডের সাফল্য মালিক শাহের মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতার উপর নির্ভর করেছে।
মালিক শাহ এর ৪ পুত্র ছিল । বার্কিয়ারুক, মুহাম্মাদ তপার , আহমেদ সেনজার এবং মাহমুদ প্রথম ।
যুক্তিযুক্তভাবে তার যুগের সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা হওয়া সত্ত্বেও, মালিক-শাহ ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু এবং বিনয়ী।
জনশ্রুতিটি রয়েছে যে, যখন মালিক শাহ কোনো অভিযানে জয়ী হতেন তখন তিনি তার সাম্রাজ্যের শক্তিতে অভিভূত হতেন আর একটি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে নীচের বাক্যগুলো বলতেন,
“হে সর্বশক্তিমান আল্লাহ, আমি নিজের ক্ষুদার জ্বালা তো সইতে পারবো, কিন্তু দয়া করে আমাকে প্রাচুর্যের হুমকি থেকে রক্ষা করুন “
সুলতান মালিক শাহ এর জীবনীসুলতান মালিক শাহ এর জীবনী
সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী সুলতান মালিক শাহ এর জীবনী

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button